বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : অবশেষে বিজেপিতে যোগ দিলেন শুভেন্দু অধিকারী। মন্ত্রিত্ব, বিধায়ক এবং দল ছেড়েছিলেন আগেই। শনিবার মেদিনীপুর কলেজ মাঠে শুরু করে দিলেন নতুন ইনিংস। সেখানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি অমিত শাহ তাঁর হাতে বিজেপির পতাকা তুলে দেন। আর তাঁকে দলে টেনেই ওই সভা থেকে তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় আক্রমণ শানালেন অমিত শাহ। কোনও রকম রাখঢাক না করেই তিনি দুর্নীতিবাজ, তোলাবাজির দল বলে তৃণমূলকে মানুষের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধেও তোপ দেগে বললেন, ‘এই তো সবে শুরু। আরও অনেক বাকি আছে। নির্বাচন যখন চলে আসবে, তখন দেখবেন, আপনি একাই শুধু তৃণমূলে রয়েছেন। আর থাকবে আপনার ভাইপো।’
এদিন শুভেন্দু ছাড়াও বিজেপিতে যোগ দেন ১০ জন বিধায়ক। তাঁদের মধ্যে ৭ জন তৃণমূলের, ২ জন বামেদের এবং ১ জন কংগ্রেসের। গেরুয়া শিবিরে এদিন নাম লেখান ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত, মন্তেশ্বরের তৃণমূল বিধায়ক সৈকত পাঁজা, হলদিয়ার সিপিএম বিধায়ক তাপসী মণ্ডল, কাঁথি উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক বনশ্রী মাইতি, গাজোলের তৃণমূল বিধায়ক দীপালি বিশ্বাস, তমলুকের সিপিএম বিধায়ক অশোক দিন্দা, কালনার তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু, নাগরাকাটার তৃণমূল বিধায়ক সুকরা মুণ্ডা এবং পুরুলিয়ার কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছাড়া পূর্ব বর্ধমানের তৃণমূল সাংসদ সুনীল মণ্ডল, আলিপুদুয়ারের প্রাক্তন সাংসদ দশরথ তিরকে, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও এদিন ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মফুলের প্রতিই নিজেদের বিশ্বাস ও আস্থার কথা ঘোষণা করেন।
এদিন অমিত শাহ নিশানা করেন পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকারকে। তাঁর কথায় উঠে আসে আমফান ঘূর্ণিঝড়ে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির কথা। আমফানের পর রাজ্য সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকা দিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু সেই টাকা বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, আমফানের টাকার খরচের হিসেব খতিয়ে দেখবে ক্যাগ। সে কথা উল্লেখ করে তিনি তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেননি। বলেন, ‘এক সময় তৃণমূলের কর্মীরা মা, মাটি ও মানুষের স্লোগান দিয়ে তাঁদের দলকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। স্লোগানটা ভালো ছিল। অনেককেই প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু দিদি, আপনি সেই স্লোগানকে কী অবলীলায় বদলে দিলেন তোলাবাজি আর ভাইপোবাদের স্লোগানে।’
তিনি তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানিয়ে বলেন, ‘আমফানের ত্রাণের টাকাও আপনার দলের আপনার অনুগত লোকেরা খেয়ে নিয়েছে। সেই ত্রাণে দুর্নীতি হয়েছে কিনা, তা এখন হাইকোর্টকে দেখতে হচ্ছে, আর ক্যাগকে দিয়ে খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু আছে কি? নেই, দিদি নেই।’ অমিত শাহের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে এদিনের সভা শেষ হয়। অমিত শাহ বলার ঠিক আগেই নিজের বক্তব্য পেশ করেন শুভেন্দু। আর সেখানে তাঁকে দেখা গেল রীতিমতো রণংদেহী মেজাজে। এর আগে কারও বিরুদ্ধে এ ভাবে সরাসরি আক্রমণ শানাতে তাঁকে খুব একটা দেখা যায়নি। এদিন কিন্তু মঞ্চ থেকে কারও নাম না করেই তিনি হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘তোলাবাজ ভাইপো হঠাও।’ স্বভাবতই মেদিনীপুরের সভা শেষ হওয়ার পর মুখ খোলে তৃণমূল। দলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা আক্রমণ শানান, ‘আপনি তো কাপুরুষ। তাই ভাইপোর নাম নেওয়ার সাহস হয়নি। বুকের পাটা থাকলে ভাইপোর নাম নিয়ে দেখান।’
সেই সঙ্গে তিনি জানান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে অপপ্রচার করা হচ্ছে। তাঁর পরিবারের কেউই মুখ্যমন্ত্রী হতে চাননি কোনও দিন। চানও না। যদিও রাজনৈতিক মহলের মতে, যদি তাই হত, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিরোধে যখন অধিকাংশ নেতা ও নেত্রী বিরক্ত, তখন তিনি তাঁকে সংযত হতেই বলতেন। তাঁর বদলে দলের অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরই গুরুত্ব দিতেন। তা হলে দলটাও ভাঙত না। এদিন তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে দলে থাকা শুভেন্দু বিজেপিতে আসার পর কী বলেন, তা নিয়ে পশ্চিমবাংলা তো বটেই গোটা ভারতের রাজনৈতিক মহলের নজর ছিল তাঁর দিকে। তিনি কী বলেন, শুনতে মুখিয়ে ছিল সকলেই। তিনিও হয়তো জানতেন তা। তাই কৈফিয়ত দেওয়ার মতোই তিনি বলেন, ‘তৃণমূলে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আত্মসম্মানে ঘা দিচ্ছিল। তাই দল ছেড়েছি। মুকুল রায়ও আমাকে ‘আত্মসম্মান হারিয়ে দলে থাকিস না’ বলেছিলেন।’
এর পর নিজের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এখন যেহেতু তৃণমূল ছেড়ে দিয়েছি, তাই আমাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, আমি নাকি মায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। আমি বলি, আমার মা গায়ত্রী অধিকারী। এবং ‘ভারতমাতা’ আমার মা। আর কেউ আমার মা নয়।’ শুভেন্দু আরও বলেন, ‘আমাকে কারা বিশ্বাসঘাতক বলছেন? তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, ১৯৯৮ সালে তো অটলবিহারী বাজপেয়ীর আশীর্বাদ ছাড়া বের হতে পারতেন না। আজ তাঁরা বড় বড় কথা বলছেন!’ এর পর কিছুটা অভিমানের সুরেই বলেন, ‘আমি দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা শুধু মানুষেরই কাজ করি। তার পরেও যখন আমার করোনা হয়, তখন তৃণমূলের কেউ কোনও খোঁজ নেননি।’
এদিকে, বিজেপিতে যে শুভেন্দু অধিকারীকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার প্রমাণও এদিন দিয়েছেন অমিত শাহ। সভামঞ্চে তাঁকে পাশে টেনে নিয়েছেন। কখনও জড়িয়ে ধরেছেন। এ ভাবেই শুভেন্দুকে নিয়ে নিজের আগ্রহ বুঝিয়ে দিয়েছেন অমিত। মেদিনীপুর থেকে কলকাতা ফেরার পথে দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়, কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের সঙ্গে শুভেন্দুকেও তুলে নিয়েছেন নিজের হেলিকপ্টারে। রাতে রাজারহাটের যে হোটেলে অমিত উঠেছেন, সেখানে হওয়া সাংগঠনিক বৈঠকেও আমন্ত্রিত ছিলেন শুভেন্দু। এরই মধ্যে খবর হল, মেদিনীপুরে থাকতেই তিনি শুভেন্দুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিল্লি যেতে বলেন। যদিও শুভেন্দু কবে দিল্লি যাবেন, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেননি।
জানা গিয়েছে, অমিত শাহ তাঁকে জানিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁকে দেখা করতে হবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদি, অমিত শাহ এবং তাঁর উপস্থিতিতেই নীলবাড়ি দখলের চূড়ান্ত কৌশল ঠিক হবে। বাংলায় জয় নিশ্চিত করার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এ ছাড়া অমিত শাহ রবিবার বোলপুরে একটি রোড শো করবেন। ওই শোয়ে থাকবেন শুভেন্দুও। অমিত শাহই তাঁকে ওই রোড শোয়ে অংশ নিতে বলেন।